স্বদেশ ডেস্ক:
অভাবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা বাবুল হোসেনের। গ্রামেও তেমন কাজ নেই। দিন দিন বাড়ছিল দেনার দায়। তাই তিন বছর আগে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। পান-সিগারেটের দোকানদারি করে কোনো রকমে ঘুরে দাঁড়ান। ঝিলপাড়ের বস্তিতে তার সাজানো-গোছানো সংসার। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোই কাটছিল জীবন। তবে সুখটা বেশিদিন সইল না, ভয়াবহ এক অগ্নিকা- পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাবুলের সবকিছু। স্ত্রী দিলারা বেগম ও তিন মেয়েসহ পরিবারের কারোরই পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই আর অবিশিষ্ট নেই।
ঈদের দুই দিন আগে মিরপুরের ১২ নম্বরে নির্মাণাধীন একটি ভবনে পাইলিংয়ের কাজ করতে গিয়ে মাটিচাপা পড়ে তার মেজ মেয়ের স্বামী সেন্টু মিয়া। অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেলেও কোমরসহ শরীরের কয়েকটি হাড় ভেঙে গেছে তার। এ দুর্বিপাকের মধ্যেই ঘরের আগুনে চোখে এখন অন্ধকার দেখছেন সর্বশান্ত বাবুল হোসেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় মিরপুর-৭ নম্বর সেকশনে সরকারি জায়গায় গড়ে তোলা ঝিলপাড় বস্তিতে ভয়াবহ এ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। জীবন নিয়ে ঘর থেকে বের হলেও স্বল্প আয়ের মানুষগুলো রক্ষা করতে পারেনি তাদের কষ্টের ধন প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ও অর্থকড়ি। সে রাতে এককাপড়ে কোনো রকমে বের হয়ে আসতে পারলেও সর্বস্ব হারিয়েছে ঝিলপাড় বস্তির পাঁচ সহস্রাধিক পরিবার। এক সময় আগুনের লেলিহান শিখা থামলেও ভস্মীভূত হয় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর স্বপ্ন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় বস্তিবাসীর ঘর, জীবনের শেষ সম্বলটুকুও। এখন সেই ধ্বংসস্তূপে খুঁজে ফিরছেন তারা ‘যদি কিছু পাওয়া যায়’ আশায়। মাথাগোঁজার ঠাঁই হারিয়ে গত চার দিন রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খোলা আকাশ ছিল তাদের শেষ আশ্রয়। বাস্তুহারা সেই বস্তিবাসীদের এখন ঠাঁই হয়েছে মিরপুরের চলন্তিকা মোড় এলাকায় অবস্থিত বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতন স্কুলসহ আশপাশের কয়েকটি স্কুলে। সেখানেই তারা খোলা আকাশের নিচে ও স্কুলের ভেতরে-বারান্দায় নিদারুণ জীবনযাপন করছেন।
গত রবিবার গভীর রাতে চলন্তিকা মোড় এলাকায় সরেজমিন দেখা গেছে, বস্তির বাসিন্দাদের কেউ কেউ স্থানীয় বঙ্গবন্ধু বিদ্যানিকেতনের ভেতরে, কেউবা বারান্দায় আবার কেউবা বেঞ্চে বসে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ রয়েছেন খোলা আকাশের নিচেও। স্কুলের রুমগুলোয় তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হয়েছে খাবারের। পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি এনজিওগুলো তাদের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানির ব্যবস্থা করেছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিতে মিরপুর চলন্তিকা মোড়ে একটি মেডিক্যাল ক্যাম্প চালু করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সহায়তায় ঢাকা আহসানিয়া মিশনের পক্ষ থেকে এ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। তবে আগুনের ভয়াবহ স্মৃতি এখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলেও ভবিষ্যতের চিন্তায় তাদের চোখে মুখে ছিল আতঙ্ক। তাদের পুনর্বাসনে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান।
বিদ্যানিকেতনে আশ্রয় নেওয়া জলি খাতুন বলেন, ‘সে দিনের আগুনের ঘটনায় আমাদের পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমরা এই বিদ্যানিকেতনে থাকতে চাই না। তিনবেলা খাবার দেওয়া হলেও এখানে থাকতে আমাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমাদের কাপড়চোপড় নাই। দিন যাচ্ছে খুব কষ্টে। এখানে ছোট বাচ্চা নিয়ে আর কতদিনই বা থাকা যাবে। সরকার ঘরগুলো ঠিক করে দিলে আমরা আবার পরিবার নিয়ে সেখানে থাকতে পারব। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, আমাদের দ্রুত আর্থিক সহায়তা দিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিন।’
ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল সোমবার বস্তিবাসীর মাঝে তিনি ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। একদিকে ডেঙ্গু অন্যদিকে অগ্নিকা-ের ঘটনায় সহমর্মিতা জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘অগ্নিকা-ের ঘটনায় যারা নিঃস্ব হয়েছেন, পুনর্বাসন না হওয়া পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকার তাদের পাশে থাকবে। এ স্থানে ঘরবাড়ি নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের পার্টি, আমাদের সরকার, আমাদের সংসদ সদস্য আপনাদের পাশে থাকবে। ক্ষতিগ্রস্ত এ এলাকায় যতদিন পর্যন্ত আপনাদের সাহায্য দরকার আমরা করব। পুনর্বাসন পর্যন্ত সরকার আপনাদের পাশে আছে। আপনারা নিজেদের অসহায় ভাববেন না, শেখ হাসিনা আপনাদের পাশে আছেন।’
মাদারীপুরের নান্নু মিয়ার ১২টি ঘর ছিল ঝিলপাড় বস্তিতে। তিনটি ঘরে পরিবার নিয়ে থাকতেন, বাকিগুলো ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতেন। আগুনে সব পুড়ে যাওয়ায় এখন পথে বসে গেছেন তিনি। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত তাওহীদ বলেন, ‘চার দিন পার হলেও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো ধরনের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে না যে, আমাদের কোথায় থাকার ব্যবস্থা করা হবে? এমন অবস্থায় আমরা পুরোপুরি বাস্তুহারা হওয়ার মধ্যে পড়ে গেছি।’ ময়মনসিংহে ঈদ পালন করতে গিয়েছিলেন মিতু বেগম। আগুনের খবরে ছুটে এসেছেন রাজধানীতে। তিনি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। স্বামী বাবুর্চি। মিতু বলেন, ‘এসে দেখি কিছুই নাই, খালি টিন। ঘরে যা ছিল সব চুরি হয়ে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছি।’
ঝিলপাড় বস্তির তিনটি ঘরে ছয়জনের পরিবার নিয়ে থাকতেন মোমেনা বেগম। অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার ও ট্রাকচালক স্বামীর টাকায় ঈদের আগে ৫০ হাজার টাকা খরচ করে কিনেছিলেন নতুন টেলিভিশন ও ফ্রিজ। সেগুলোও পুড়ে গেছে ভয়াল সেই আগুনে। শুধু এ কজনই নয়, তাদের মতো হাজারও মানুষের আক্ষেপ ও হতাশায় এখন চলন্তিকা বস্তি এলাকার বাতাস ভারী। কেউ জানে না কবে নাগাদ তাদের পুনর্বাসন করবে সরকার। তাই প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে সাহায্য দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের জন্য কাজ করা বেসরকারি এনজিও রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টারের প্রকল্প পরিচালক বেবি রিটা বলেন, ‘আমরা আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া পরিবারগুলোর জন্য স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করে থাকি। সরকারের পক্ষ থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো ইঙ্গিত পাইনি তাদের কোথায় স্থায়ীভাবে থাকতে দেওয়া হবে। সেটা জানতে পেলে আমরা পুরোদমে কাজ করতে পারব।’
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী রজ্জব হোসেন বলেন, ‘আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা করছি। তারা বাসস্থানে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আর স্থানীয়রা যাদের চিহ্নিত করে দিচ্ছেন, তাদের নামই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।’ ডিএনসিসির (অঞ্চল-২) নির্বাহী প্রকৌশলী ইনামুল কবীর বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীদের যেখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সেখানে খাবারের কোনো সংকট নেই। গৃহহারা মানুষ যেন অনাহারে না থাকে সে জন্য আমাদের সজাগ দৃষ্টি আছে। তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।’
সিটি মেয়র আতিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, বস্তিবাসীর পুনর্বাসনের জন্য ২০১৭ সালে বাউনিয়া বাঁধে জায়গা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে ইতোমধ্যে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়ে গেছে। চলন্তিকা মোড়ের ১০ হাজার বস্তি পরিবারকে পর্যায়ক্রমে স্থানান্তর করা হবে।